বেঁচে থাকার প্রাপ্তি

কেমন যেন হয়ে গেছি...এখন লিখতে ইচ্ছা হয় না। লিখার অনুভুতি গুলো হারিয়ে যাচ্ছ। এই ভর দুপুরে তপ্ত পিচ ঢালা পথ পেরিয়ে ফিরে এসে কেন আমি লিখছি...? আমি নিঃশব্দ বয়ে চলি। আমাকে কেউ বোঝে না, জানে না। আমাকে কেউ জানেনা, একটুও না। আমার শব্দ আর অনুভূতি বুঝতেও পারে না। সবার মাঝে থেকেও আমি নেই। এক সময় হৃদয়ের চেপে রাখা আর্তনাদ গুলোকে শব্দ দিতাম, লোকে তাও বিরক্ত হতো বলে শেষে লেখাই থামিয়ে দিয়েছি। আমি হতাশ হই প্রায়ই, তখন পাথরের মত বসে থাকি। অথবা দু’হাতের আঙ্গুল গুলো একে অপরের মাঝে প্রবেশ করিয়ে সময় ক্ষেপন করি। আঙ্গুল গুলো প্রবলভাবে অবাধ্য হতে চায় তবু আমি নির্বিকার হতে চাই।

কী হবে লিখে...? অথবা, কী_বা হবে না লিখে? কিছুই হবে না। আমি তো জানি, এই শহরের অন্য সবার মতই আমিও একদিন টুপ করে চলে যাব। অনন্তের জগতে, অজানা জগতে।আমি প্রায়ই নিঃশ্বাস নিই বড় করে, সেই-ই তো পথের শেষ। চলে যাব বলে যখন ভাবি, খারাপ লাগে। মনে হয়, কারো নামে ভুল কথা বলে ফেলেছি কিনা। আমি থাকব না, তখন তাদের হৃদয়ের ক্ষত গুলো আমি মুছে দিতে পারব না।

নইলে আমার এই বেঁচে থাকা, এই প্রতি দিনের নিঃশ্বাস আমার অনেক গুলো দীর্ঘশ্বাসের সমষ্টি। কেউ আমাকে তাচ্ছিল্য করে, কেউ আমাকে খোঁটা দেয়, শারীরিক- মানশিক যন্ত্রণা গুলো আমাকে কাবু করে ফেলে। আমি নির্বিকার বেঁচে থাকি। মাঝে মাঝে আমার জড়তা বড্ড বেশি হয়ে যায়। কেউ আমাকে ‘বাস্তববাদী’ হতে বলে, কেউ বলে কল্পনার ‘রোমান্টিকতা’ ফেলে বাস্তবে পা দিতে। অথচ, আমি একজন মানুষ যে শুধু অনুভব করি দৃষ্টি ছাড়িয়ে একটু বেশি। বাস্তববাদীদের বাস্তব চোখের চাইতে বড় বাস্তব দেখতে পাই। স্বাভাবিকতাকে রোমান্টিক হিসেবে যারা ভাবে তার চাইতে বেশি স্বাভাবিক আমি। আমি আমার এই চোখ নিয়ে বড্ড বিব্রত। কেনই বা এই অনুভূতি আর দৃষ্টি, কেনই এই অসহায় নিস্পৃহা। আমি নিয়ত তাদের সাথেই যুদ্ধ করি। অনেকটা অন্যদিকে তাকিয়ে কাজ করার মতন। আমি আছি, আমি নেই। আমি না থাকার মতই।

কী হবে আমি যদি অন্য সবার মত না হই...? কী হবে যেমন করেই হোক পেরিয়ে যাই এই একটি জীবন। কে সফল হয় ...?  চলে যাওয়াই সব চাইতে বড় বাস্তব।  আমি কখনই ভুলতে পারিনা এগুলো কিছুই আমার নয়। আমার এই শব্দ গুলো হয়ত রয়ে যাবে যেদিন আমি থাকব না। কেউ হয়ত পড়বে আমার কথা, তখন আমি থাকব না। তারা জানবে, আমার হৃদয়ে অনুভূতি ছিলো, যেমনি তাদের আছে। আমি নেই, আমি বাস্তব পৃথিবীতে চলে গেছি। যোগ্যতা বেশি ছিলনা আমার, তবু আমি বেঁচে ছিলাম। আমার ক্ষুদ্রতার ভারে আমি নুয়ে ছিলাম জীবনভর, তবু ছেড়ে দিইনি কিছু। তবে অবাক লাগে, আমার ব্যক্তিগত সীমাবদ্ধতার কারণে যতটা না আঘাত পেয়েছি, তার চাইতে বেশি পেয়েছি আমার ভিন্নতার কারণে।

লিখতে ইচ্ছা হয় না আর, ক্লান্ত লাগে। ক্লান্ত লাগে নগর জীবন। ক্লান্ত লাগে এই তপ্ত দুপুর, ক্লান্ত লাগে অনুভুতি গুলো । জানি, আমি লিখলেও কিছু হবেনা, না লিখলেও হবে না। ঝরে যাওয়া বৃষ্টির জলধারা,কচু পাতার উপরে পানির ফোঁটা, ভেজা কাক, ভেজা রাস্তায় ছুটে যাওয়া বৃষ্টিস্নাত শিশুর দৌড়ে চলা — এই দৃশ্যগুলো আমাকে আগের মত মুগ্ধ করে না। আমি কি মরে যাচ্ছি...? আমি কি মরেই গেছি ইতো মধ্যে..? মৃত আত্মাকে নিয়ে আমি আর ভাবিনা। আমি আর অপেক্ষার প্রহর গুণিনা। বেঁচে থাকাই আমার কাছে অদ্ভুত এক উত্তেজনা। এই নিঃশ্বাস, এই বাতাস, এই আলো, এই  তপ্ত রোদ সবই আমার বেঁচে থাকার প্রাপ্তি।  এত টুকুই বা পায় ক’জনা..??