অবাস্তব কল্পনা

বিলাসিতা আর দুঃখ বিলাস এক নয়। অনেকটা গানের কথার মতো-"মনটা যদি না থাকতো আমার কিছুই মনে পড়তো না, এই মন তবে এমন করে কেমন কেমন করতো না- আর তাকেও মনে পড়তো না ।" আমার যখন বিষণ মন খারাপ হয়, হাজার মাইল দূরে থাকা মানুষটির দরজায় গিয়ে আনমনে কড়া নাড়ি। মানুষটা খুব বেশি ভালো- দরজা খুলে আমাকে আশ্রয় দিতো তার কাছে নিতো প্রতিনিয়ত। আমার বুকের ভেতর যখন বোকা সোঁকা কষ্ট গুলো চেপে বসতো আনমনেই, আমার অবচেতন মনের তখন ইচ্ছে হতো- এই ভারটা একটু হালকা করা দরকার। আমি মানুষটাকে চোখ বুঝে ডাকতাম। চোখ বন্ধ করে যখন তাকে দেখতাম, কষ্ট গুলো কিভাবে যেন হালকা হয়ে যেতো চোখের পলকেই।

এই বিশাল পৃথিবীতে যখন নিজেকে খুব একলা লাগতো, চোখ বুজে মানুষটার সামনে চলে যেতাম। আমি কিছু বলতে যাবো তার আগেই মানুষটা বুঝে নিতো। মানুষটা চোখে চোখ রেখে বলতো, "আরেহ আমি আছি না...?" তখন আমার আর একলা লাগতো না। সুখি সুখি একটা অনুভূতি হতো।

মাঝরাতে প্রায়শই আমার ঘুম ভেঙ্গে যায়। মাঝরাতে ঘুম ভেঙ্গে গেলে কেমন যেন একটা অস্থির রকমের "কোথাও কেউ নেই" নামক অনুভূতি জেগে উঠে। এই অনুভূতিটা খুব কষ্ট দেয়, আমাকে ঘুমাতে দেয় না। চোখ বন্ধ করলেই এই মানুষটা তখন 'প্লিজ ঘুম হয়ে যাও চোখে' আর ঘুম হয়ে আসতো আমার মন খারাপের রাতে। আর আমিও ঘুমিয়ে পড়তাম অস্থিরতা থেকে।।

সারা দিনে একলা পথ চলতে চলতে সারাদিনের জমে থাকা গল্প গুলো বলার জন্য একজন মানুষকে খুব দরকার হতো। আমি মানুষটিকে ডাকতাম। মানুষটা আমার হাত ধরে আমার পাশে বসে গভীর মনোযোগ দিয়ে আমার সব অর্থহীন, মূল্যহীন গল্প গুলো ক্লান্তিহীন ভাবে শুনতো। আমার হাসিতে হাসতো খুব, আর কান্নার রঙটা বুঝতো নিমিষেই।। 

আমার কখনোই কোন কিছুর নেশা ছিল না, এখনো নেই। কিন্তু আস্তে আস্তে কিভাবে যেন মানুষটার নেশা হয়ে গেলো আমার। খুব ভালোভাবেই বুঝতে পারচ্ছিলাম মানুষটার প্রতি আমি কিভাবে যেন নেশাগ্রস্ত হয়ে গেলাম। দিন দিন এই নেশা তীব্র থেকে  তীব্রতর আকার ধারণ করলো। কতটা তীব্র সেটা আমি আগে বুঝতে পারি নি তবে এতোটা বুঝতে পারতাম তীব্রতার মাত্রা গভীর... একদিন টের পেলাম খুব ভালোভাবে...

কোন এক শীতের সকালে ঘুম ভেঙ্গে আমি আবিষ্কার করলাম, কি যেন আর আগের মত নেই। আমি পাগলের মতো হয়ে যেতে লাগলাম কিন্তু কিছুই খুঁজে পেলাম না। আমি পাগলের মত মানুষটিকে ডাকলাম, কিন্তু মানুষটা আমার ডাকে সাড়া দিচ্ছে না। অনেকটা এমন সে আমার ডাক শুনছে না। আমার প্রশ্নের জবাব তাচ্ছিল ভাবে দিয়ে সে কোথায় যেন হারিয়ে গেলো। নিজের মাঝে আমার ছোট ছোট গল্প গুলো জমতে থাকলো। বুকটা আসতে আসতে ভারী হতে লাগলো। বুকের ভেতর এত এত বোকাবোকা কষ্ট অপেক্ষা করতো মানুষটার জন্য। মানুষটা আর আগের মত এসে পাশে বসে গল্প শুনছে না...মন খারাপের রাতে মানুষটা 'ভিনদেশী তারা' হয়ে আমার আকাশে জ্বলতে থাকে। সে আমার ধরা ছোঁয়ার বাহিরে। তাকে আর ছুঁতে পারি না, একদম না...।।

বুঝতে পারলাম মানুষটি ছিল আমার কল্পনা। বাস্তবের সাথে যার কিছুই মিল নেই। মানুষের মন পৃথিবীর সবচেয়ে বিচিত্র জিনিস। ভালোলাগা নিমেষেই তৈরি হয়, ভালোলাগা নিমেষেই চলে যায়।

আমার মনে জমে থাকা ছোট ছোট গল্প, বুকের ভেতর চেপে থাকা ভারী ভারী কষ্ট, আমার নিঃঘুম রাতের ঘুম ভাঙ্গা সকালের অবচেতন মন, ভীড়ের মাঝে ফুটপাতের প্রতিটি পায়ের পদক্ষেপ, সারাদিনের এলোমেলো কাজের ফাকে বা কফির মগে চুমুকে মনে পড়ে যাওয়া মানুষটার অস্তিত্বের স্মৃতির কথা। ওরা তো বুঝে না এটা বাস্তব না, এটা কল্পনা ছিল। ওরা খুঁজতে থাকে সেই মানুষটাকে... ওরা প্রশ্ন করে, "কেন বাস্তব নয় এগুলো...?"

আমি এই কেন এর উত্তর খুঁজে পাইনি, আমার কাছে এই 'কেন?' এর উত্তর নেই। আমি জানি না আমার কল্পনা কেন আমার বাস্তবতার মতো নয়। আমি শুধু জানি,  আমার কল্পনাটা ভুল ছিল। ভুল কল্পনায় আমি মানুষটির কাঁধে আশ্রয় চেয়েছিলাম, ভুল কল্পনায় মানুষটির আঙ্গুলের ফাঁকে অধিকার খুঁজেছিলাম। কল্পনায় যে মানুষটার সাথে থাকার নেশা একসময় খুব ভরসা দিতো, সেই অভ্যাসই একসময় তীব্র কষ্ট দেয়। সেই কষ্ট থেকে বের হওয়া খুব কঠিন, সেই তিব্র নেশা থেকে চাইলেই বের হওয়া যায় না...