বিষণ্ণতার গল্প
আজ আমি ভালবাসার নয়, লিখবো বিষণ্ণতার গল্প। আমার জীবনের গল্প, আর এটা উৎসর্গ করবো আমার পরিচিত অপরিচিত বিষণ্ণতায় ভোগা মানুষদের।আমার বলতে দ্বিধা নেই আমি কয়েক বছর ধরেই বেশ হতাশ, নিরাশাবাদী, অনেক বেশি বিষণ্ণতা কাজ করে। জীবন কে বার বার গুছিয়ে নিতে যেয়েও অনেকটা ব্যর্থ। কিন্তু আমি তো আমার বিষণ্ণতা গুলো নিয়েই বেশ আছি।কেন আমি বিষণ্ণ...? মাঝে মাঝে এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে আরো বেশি বিষণ্ণ হয়ে যাই।
কোন কোন বিষণ্ণতার গল্প পৃথিবীর কাউকেই বলা যায় না। অদ্ভূত সেই বিষণ্ণতা, বিচিত্র সেই মন খারাপ।মাথার ভেতর "ভাল্লাগেনা" নামের পোকারা মাকড়শার জালের মত এলোমেলো জাল বুনতে থাকে। সেই জালে হাসি আর আনন্দ গুলো এক এক করে আটকে যায়। হারিয়ে যায়, মুছে যায় হাসি আর খুশি। দুঃস্বপ্নের মত সময় আসে মাঝে মাঝে।চোখ বুজে পড়ে থাকতে হয়, ঘুম ভাঙ্গলেই জগতটা খুব অচেনা লাগে।আশপাশটায় চোখ বুলিয়ে হুট করে মনে পড়ে যায়।ভয়াবহ এক মন খারাপের রাজ্যের রাজা হয়ে বসে আছি আমি।তখন আবার চোখ বুজতে ইচ্ছে হয়।
আমি নিজেও জানি না একটু একটু করে বেড়ে উঠা এই বিষণ্ণতার শুরু। বিষণ্ণতা হয়তো বেড়ে ওঠার পরিবেশ, হঠাৎ ঘটে যাওয়া কোন ঘটনার শক বা পারিবারিক বিষণ্ণতায় ভোগা জীনগত সমস্যা থেকেও হতে পারে। তবে হঠাৎ করে বিষন্নতা জন্ম নেয় না। বিষণ্ণতা কাউকে কখনোই হুট করে পেয়ে বসে না।এটাও অনেকটা দীর্ঘ সময় নিয়ে অর্জন করে নিতে হয়। অর্জন...!! হ্যাঁ অর্জন...কারণ, বিষণ্ণতার স্তরে নিজেকে টেনে নিতে মনের অনেক সময় লাগে। মন হঠাৎ করে বিষণ্ণতার স্তরে ডুবে যেতে পারে না।অনেক ধাপ পেরুতে হয়। শুরুতে কোন কিছুতে ব্যর্থ হলে কষ্ট লাগে। আপনজন কেউ হারিয়ে গেলে দুঃখ লাগে, কাউকে না পাওয়ায় বা কেউ ছেড়ে যাওয়ায় একটা যন্ত্রণার অনুভূতি হয়, সফলতার পিছনে ছুটতে ছুটতে নিজেকে হারিয়ে ফেলা। এগুলোকে কাটিয়ে উঠতে পারে অনেকেই, তারা মনের দিক থেকে সফল। কিন্তু কেউ কেউ হয়তো হেরে যায়, হেরে যায় নিজের মনের সাথে। তখন মনে আস্তে আস্তে ভর করে হতাশা, নিরাশা, নিজের প্রতি একটা বিরক্তি ভাব। সেটাও বেশ ভালো, একটা কষ্ট কষ্ট অনুভূতি থাকে, হেরে যাবার যন্ত্রণা থাকে। আবার হতাশার মাঝেও হঠাৎ আনন্দের কিছু ঘটলে খানিকটা সুখ খুঁজে পাওয়া যায়। কিন্তু হতাশা বা নৈরাশ্যের স্তরে মানুষ বেশিদিন থাকে না। যারা এই স্তরে একবার যাত্রা শুরু করে তারা দ্রুত কাটিয়ে উঠতে পারলে তো ভালো, তা না হলে পরবর্তী স্তরে আছে বিষণ্ণতা, অবসাদ। হতাশার স্তর যন্ত্রণা এবং কষ্টের বলেই মানুষের ব্রেইন তাকে এর থেকে বাঁচাতে তাকে টেনে নিয়ে যায় বিষণ্ণতায়। এখানে একবার ঢুকে পড়লে জগতের আর কোন কিছুতেই কোন কিছু যায় আসে না। সব কিছু তুচ্ছ মনে হয়।না আছে কোন আনন্দের অনুভূতি, না আছে কষ্টের। সব কিছু মনে হয় রঙহীন ধূসর, একঘেয়ে, বিরক্তিকর। অনেকটা স্বাদ গন্ধহীন কাগজ চিবোনর মতন।জীবনের উদ্দেশ্য গুলো কেমন গুলিয়ে যায়।নিজেকে অনেকটা মনে হয় ঝর্না ধারায় পড়ে থাকা এক খন্ড নিষ্প্রাণ পাথর, যার জলের তৃষ্ণা আছে, কিন্তু জল তাকে ভেজাতে পারে না, শুধু ছুয়েই চলে যায়।গায়ে লাগে না...।
এখন আমি ২৫ বছরের তরুণ, এই স্বল্প সময়ের জীবনে এখনই প্রায়ই ভাবি যদি পালিয়ে যেতে পারতাম জীবন কে ফাঁকি দিয়ে।ক্লাস ফাঁকি দেওয়ার অভ্যাস না থাকলেও, জীবন কে ফাঁকি দিতে প্রায়ই ইচ্ছে হয়। সবসময় এমন ছিলাম না আমি, হথাৎ মনে হয় একটু বেশিই এমন হয়ে যাচ্ছি। এক সময় আমিও স্বপ্ন দেখতাম, প্রাণ চাঞ্চল্য আর উৎসাহে ভরপুর চার'দিক। নিজের সামনে একটু একটু করে নিজের পরিবর্তনটা দেখেছি। এই একটু পরিবর্তন টা যে জীবনের এতোটা পরিবর্তন এনে দিবে সেটা হয়তো কখনো অবচেতন মন বুঝতে পারে নি। কিন্তু চেষ্টা করেও খুব বেশি নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনি।এখন মনে হয় আমি হারিয়ে গিয়েছি।আগের সেই আমাকে আর কোথাও খুঁজে পাই না। দুঃখ, কষ্ট বা আনন্দ গুলো মনে হয় আমাকে আর খুব একটা ছুঁয়ে যায় না। মনে হয় এক সময় খুব জোরে ঝংকার তুলে বাজতে থাকা আমার জীবনের সুরের কোথাও ছন্দ পতন হয়েছে, যেন একটু একটু করে একটা তানপুরা পুরনো হতে হতে তাল কেটে যেয়ে বেসুরো হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আমি বুঝতে পারি এটা হঠাৎ করে কখনোই হয়নি। খুব আস্তে আস্তে অনেক সময় নিয়ে আমি এই স্তরে এসে পৌঁছেছি। নিজেকে যখন বিষণ্ণ হিসাবে আবিষ্কার করতে শুরু করি তখন থেকেই আমি ভাবতে থাকি কেন আমি এমন হলাম।উত্তর টা প্রশ্নের মাঝে সীমাবদ্ধ...।
“The woods are lovely, dark and deep,
But I have promises to keep,
And miles to go before I sleep,
And miles to go before I sleep...”