একাকীত্বে বাঁচা
জীবনের অর্থই হচ্ছে একটি যাত্রা। যে যাত্রাপথে আপনার সাথে হাজার মানুষের দেখা হবে, কথা হবে, আপনার সাথে বন্ধুত্ব হবে আবার তা চোখের পলকে ভেঙে ও হারিয়ে যাবে। জীবনের সবটুকু পথই সুন্দরভাবে কাটবে তা কিন্তু নয়। কারণ আপনি খারাপ সময়ের দেখা না পেলে সুখের মূল্য বুঝবেন না। তেমনি জীবন পথে অতিবাহিত হওয়া কঠিন সময় আপনার সংস্পর্শে না এলেও আপনি ভেতর থেকে কতটা আত্মবিশ্বাসী আর নিজের প্রতি আস্থা রাখতে পারেন তাও বুঝে উঠতে পারবেন না। কঠিন সময় কখন আসবে তা যেমন কেউ জানেনা তেমনি সেই সময়ে কী করতে হবে সেটাও বলা যায় না। কেউ ভাবেন এই সময় আর শেষ হবার না। নিজের প্রতি নিজের এই কম আত্মবিশ্বাস আপনার জেতা বাজিটাও মাঝে মাঝে হারিয়ে দেয়।
মানুষ একাকী বাঁচতে পারে না। যাবতীয় দুঃখ কষ্ট আর বিপদের দিনে কাছের মানুষ গুলোই তার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় সবার আগে। মানুষ একা থাকতে পারে না বলেই একাকিত্ব অনেক সময় অসহনীয় হয়ে ওঠে। সেই একাকিত্ব ঘোঁচাতেই শুধু নয়, মানসিক স্বাস্থ্যের জন্যও প্রয়োজন কাছে থাকার, পাশে থাকার মতো একজন মানুষ। যে সব কিছুতে সময়ে অসময়ে পাশে থাকবে, বিপদে ভরসা দিবে।
সম্পর্ক জীবনের বৈচিত্র্যময় আনন্দকে চিনতে সাহায্য করে। প্রিয় কারো সঙ্গে সময় কাটানো নিশ্চয় স্মৃতিকে পরিপূর্ণ করে। কিন্তু তার মানে এই নয়, জীবন সবার একই রকম কাটবে বা সবসময় একই রকম যাবে। কখনো কখনো একাকীত্ব অপরিহার্য হয়ে উঠে। এ একাকীত্ব নিজেকে বোঝাপড়ার জন্য খুবই দরকারী। একাকীত্ব মানুষকে এমন অভিজ্ঞতা দেয়, যা অন্য কোনোভাবে অনুধাবন করা সম্ভব নয়। একাকীত্ব ভয়ংকর এক অসুখ যা তোমাকে জ্বালাবে পোড়াবে, কিন্তু মারবে না। প্রতি মুহূর্তে মনে করিয়ে দেবে তুমি সবার মতো হতে পারোনি, তোমার মতো কেউ নেই। অদৃশ্য এই অসুখ তোমাকে কুরে কুরে খাবে কিন্তু তোমার শরীরে রক্তে তার কোনো চিহ্ন থাকবে না। তাই কেউ ধরতে পারবে না তোমার অসুখ, তোমার কষ্ট । তুমি জ্বলে, পুড়ে ছাই হবে। সেই ছাই থেকে ফিনিক্স পাখির (ছাই থেকে বারবার জন্ম যে পাখি) মতো আবার জন্মাবে। তোমার রক্তক্ষরণ, ধ্বংস হয়ে যাওয়া কেউ বুজবে না, কেউ বুঝবে না তোমার একাকীত্ব।
অতিরিক্ত মন খারাপ হলে মানুষ একেবারে নীরব নিথর হয়ে যায়। একা থাকতে ভালোবাসে। কারণ তখন তার সমস্যাকে নিজের মত করে কেউ দেখে না কিংবা মূল্যায়ন করে না। তাই মন খারাপের বেলায় একাকীত্বই হয় মানুষের একমাত্র সঙ্গী। একা থাকতে থাকতে একটা সময় একাকীত্বের মাঝে নিজেকে সপে দেয়। সে নিজেও বুঝতে পারে না সে কিভাবে জীবন যাপন করছে। .
নিঃসঙ্গতা বলতে সাধারণত একাকী থাকা বা নির্জনতাকে বুঝালেও মূলত এটি একটি মানসিক অবস্থা। যখন মানুষ শূন্যতা অনুভব করে এবং সবার কাছ থেকে নিজেকে গুটিয়ে রাখে তখন নিঃসঙ্গতা দেখা দেয়। নিঃসঙ্গতায় ভোগা মানুষেরা অনেক সময় অন্যের সঙ্গে যোগাযোগ করতে চাইলেও তাদের মানসিক অবস্থার কারণে তা পারে না। মানসিক অবস্থার পরিবর্তন একদিনে হয় না, একটু একটু করে হোঁচট খেতে খেতে হয়। নিজের মনের সাথে, ইচ্ছের সাথে হেরে যেতে হয়। যদি নিজের কথা একটু বলি তাহলে বলতে হয়- গত ৭০ দিন আমি একা একটা বাসায় ঢাকা অবস্থান করছি। অনেকটা পরিস্থির জন্য। চাইলেই হয়তো এই পরিস্থিতির দোহায় না দিয়ে পরিবারের কাছে চলে যাওয়া যেত। কিন্তু কোন এক কারনে যাওয়া হয়নি। যাওয়া হয়নি বললে ভুল হবে, ইচ্ছে করেই যাই নি। হোক সেটা পরিবারের প্রতি অভিমান বা অন্য কিছু। আমার কি এই সময় গুলো ভালো কেটেছে? একা একটা বাসায়, বুয়া নেই, কাজের লোক নেই, কথা বলার একজন মানুষ নেই। একটা মানুষের কতোটা নিজের প্রতি অভিমান, অভিযোগ থাকলে এতোটা একা হয়ে যেতে পারে...!! বড্ড ব্যস্ত জীবনে একাকীত্বের চতুর থাবা আজ বারে বারে বিপর্যস্ত করছে। এই একাকীত্ব যাতে না আসে, একে নির্মূল করতে নিজেকে ব্যস্ত রাখার কতই না চেষ্টা করি। একাকীত্বের মাঝে নিজের সত্ত্বাকে বিলিয়ে দিয়েছিলাম, এতোটাই সপে দিয়েছিলাম যে প্রিয় মানুষ গুলোর সাথে সময় কাটানো কেমন হয় সেই অনুভূতি গুলোই ভুলে গিয়েছি। ভুলে গিয়েছি শেষ কবে প্রিয় মানুষের সামনে গিয়েছিলাম, শেষ কবে বাড়ি গিয়েছিলাম, ভুলে গিয়েছি শেষ কবে মন থেকে হেসেছিলাম। একাকীত্বের মাঝে ডুবে গিয়ে ভুলে গিয়েছি আমি এখনো জীবিত একজন মানুষ। এই মুহূর্ত গুলো মানুষ মানুষকে খুব ভালোভাবে চিনতে সহায়তা করে। একাকীত্ব মানুষকে খুব ভয়ংকর কিছু অভিজ্ঞতা দেয়...।। জীবন যাত্রার ভিন্নতার সাথে ঘুণপোকার বাসার মতোই আজ অন্যতম অপ্রতিরোধ্য সঙ্গী হয়ে উঠেছে একাকীত্ব।
আগামিকাল জীবনে কী ঘটতে যাচ্ছে তা কেউই জানি না, হতে পারে এই লিখাটাই শেষ লিখা। তারপরেও এই অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ নিয়ে আমাদের কল্পনার শেষ নেই। আর এই কল্পনা মাঝে মাঝে গিয়ে দাঁড়ায় চিন্তা আর জীবনকে কঠিন করার মাধ্যম।